পেছনের বেঞ্চ থেকে ইউ-আকৃতির বৃত্তে: এক সিনেমার বদলে দেওয়া গল্প
এ.কে.এম মাজেদুল আলম(ইভান)
কেরালার এক স্কুলে হঠাৎ করেই বদলে গেল শ্রেণিকক্ষের দৃশ্য। সারি সারি বেঞ্চ নেই, নেই সামনের কাতারে বসা অগ্রগামী ছাত্র কিংবা পেছনের অদৃশ্য ‘দুর্বল’ দল। পুরো ক্লাসরুমের বেঞ্চগুলো টেনে এনে বানানো হয়েছে আধা-গোলাকৃতি বসার ব্যবস্থা। যেন ইংরেজি ‘U’। এই নতুন ছকের মধ্যে নেই পেছনে পড়া কারও হীনমন্যতা, নেই সামনে বসার অহংকার। সবাই এখন এক দূরত্বে, চোখের সামনেই — শ্রবণযোগ্য, দৃশ্যমান এবং গুরুত্বপূর্ণ।
এই পরিবর্তনের মূলে আছে এক ছায়াছবি — মালায়ালম ভাষার, নাম ‘স্থানার্থী শ্রীকুট্টান’।
শ্রীকুট্টানের চোখে দেখা ক্লাসরুম
ছবির কেন্দ্রীয় চরিত্র শ্রীকুট্টান, সপ্তম শ্রেণির এক পেছনের বেঞ্চবাসী ছাত্র। দেরিতে আসা, পড়াশোনায় মাঝারি, শিক্ষকের তাচ্ছিল্যের চেনা লক্ষ্যবস্তু। তার ঠিক বিপরীতে ক্লাসের সামনে বসা অম্বাদি—শ্রেণিশ্রেষ্ঠ, শিক্ষকের প্রিয়। এই দুই ছাত্র যেন শ্রেণিকক্ষে দুটি বিপরীত মেরু—একটি কর্তৃত্বের, অন্যটি অবহেলার।
কিন্তু সেই ক্লাসে হঠাৎ শুরু হয় নেতৃত্ব নির্বাচনের নাটকীয় প্রতিযোগিতা। শ্রীকুট্টান সাহস করে বলে, “আমি নির্বাচন করব।”
তার পাশে দাঁড়ায় কিছু বন্ধু।
চক্রপাণি স্যারের কপালে ভাঁজ পড়ে, অম্বাদি দ্বিধায় পড়ে যায়।
এই চুলচেরা রাজনৈতিক পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে ভেসে ওঠে ছোট ছোট ছাত্রদের মধ্যে লুকিয়ে থাকা আত্মসম্মান, আত্মবিশ্বাস আর পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা।
সিনেমা যখন জীবনের প্রতিচ্ছবি
চলচ্চিত্রের শেষ দৃশ্যটি যেন এক শিক্ষা-দর্শনের নতুন ব্যাখ্যা। ছাত্ররাই বেঞ্চ টেনে এনে বসে ‘ইউ’-আকৃতিতে। কেউ আর পিছনে নয়, কেউ আর সামনেও নয়। সকলেই এক বৃত্তে। এই একতা, এই সাম্য—শুধু বসার কৌশল নয়, এটা এক মানসিক অবস্থান, যেখানে প্রতিটি শিশু গুরুত্বপূর্ণ।
এই চলচ্চিত্রের প্রভাবেই কেরালার অন্তত ছয়টি স্কুলে চালু হয়েছে এই ইউ-আকৃতির বসার পদ্ধতি। এমনকি উত্তর ভারতের পাঞ্জাবেও এক স্কুলে দেখা যাচ্ছে একই আয়োজন। আর নরওয়ের কিছু স্কুলে এই পদ্ধতি চলছে বহু আগে থেকেই।
কেন এই পরিবর্তন জরুরি?
আমরা জানি, পেছনের বেঞ্চ মানেই যেন অযোগ্যদের আসন। ধীরে ধীরে তারা হয়ে ওঠে ‘কম গুরুত্বপূর্ণ’। কিন্তু এই সিনেমা আমাদের প্রশ্ন তোলে—পেছনে বসা মানেই কি পিছিয়ে পড়া?
শিক্ষা যদি হয় মুক্তচিন্তা, সম্মান ও অন্তর্ভুক্তির জায়গা, তাহলে ‘সামনে’ ও ‘পেছনে’—এই বিভাজন কি আদৌ যুক্তিযুক্ত?
ছবিটি দেখা যাবে কোথায়?
এই হৃদয়স্পর্শী চলচ্চিত্র ‘স্থানার্থী শ্রীকুট্টান’ এখন সাইনা প্লে (Saina Play) নামের ওটিটি প্ল্যাটফর্মে দেখা যাচ্ছে। যাঁরা কেবল ছবি দেখেন না, উপলব্ধি করেন—তাঁদের জন্য এটি এক অনন্য অভিজ্ঞতা।
শেষ কথা:
একটি সিনেমা, একটি বেঞ্চের অবস্থান, আর তার মধ্য দিয়ে উঠে আসা সমতার দর্শন—এটাই ‘স্থানার্থী শ্রীকুট্টান’-এর মাহাত্ম্য। হয়তো আমাদের শিক্ষাপদ্ধতিও একদিন এই গোল বৃত্তে পৌঁছবে—যেখানে পিছনে কেউ থাকবে না, সবাই একসাথে এগোবে।