জানাজা যখন রাজনীতি বলে: মুজিব, জিয়া ও হাদির বিদায়ে রাষ্ট্র ও জনমানস
অনেক সময় জানাজা শুধু শোকের বিষয় থাকে না। জানাজার আয়োজন, রাষ্ট্রের আচরণ এবং মানুষের উপস্থিতি স্পষ্ট করে জানিয়ে দেয়—ক্ষমতা কোন দিকে যাচ্ছে, জনগণ কী ভাবছে এবং রাষ্ট্র কী বার্তা দিতে চায়।
বাংলাদেশের ইতিহাসে শেখ মুজিবুর রহমান, জিয়াউর রহমান ও শরীফ ওসমান বিন হাদির জানাজা সেই বাস্তবতাই ভিন্ন ভিন্ন সময়ে তুলে ধরেছে।
শেখ মুজিবুর রহমান: নীরবতা, ভয় ও ক্ষমতার বদল
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হন। পরদিন তাঁর দাফন হয় অত্যন্ত নীরব ও সীমিত পরিসরে। সেনাবাহিনীর ব্যবস্থাপনায় মরদেহ ঢাকা থেকে টুঙ্গিপাড়ায় নেওয়া হলেও রাজধানীতে কোনো রাষ্ট্রীয় শোভাযাত্রা বা সর্বসাধারণের বিদায় জানানোর সুযোগ দেওয়া হয়নি।
টুঙ্গিপাড়ায় দ্রুত দাফন সম্পন্ন করা হয়। ইসলামি বিধান মানা হলেও বড় কোনো আনুষ্ঠানিকতা ছিল না। সেনারা পাহারায় ছিল, গ্রামবাসীরা দূর থেকে দেখেছেন। ক্ষমতা বদলের সেই মুহূর্তে তাঁর মরদেহকে শ্রদ্ধার প্রতীক নয়, বরং রাজনৈতিক ঝুঁকি হিসেবেই দেখা হয়েছিল। এই নীরব জানাজা ছিল নতুন ক্ষমতার ভয় ও অনিশ্চয়তার প্রতিচ্ছবি।
জিয়াউর রহমান: রাষ্ট্রীয় মর্যাদা ও পুনঃস্থাপন
১৯৮১ সালের মে মাসে চট্টগ্রামে ব্যর্থ অভ্যুত্থানে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান নিহত হন। শুরুতে তাঁর দাফনও ছিল তাড়াহুড়ো ও সীমিত পরিসরে। তবে অল্প সময়ের মধ্যেই পরিস্থিতি ও রাষ্ট্রীয় অবস্থান বদলায়।
তাঁর মরদেহ ঢাকায় আনা হয় এবং পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। রাজধানীর রাস্তায় লাখো মানুষের ঢল নামে। সামরিক সালাম ও কুচকাওয়াজের মধ্য দিয়ে শেরেবাংলা নগরে, জাতীয় সংসদের পাশে তাঁকে দাফন করা হয়। এটি ছিল রাষ্ট্রের কেন্দ্রেই তাঁর অবস্থান নিশ্চিত করার প্রতীক—ক্ষমতার ধারাবাহিকতার বার্তা।
শরীফ ওসমান বিন হাদি: জন মানুষের আবেগ, শহীদি আকাঙ্ক্ষা ও বিচার-দাবি
২০২৫ সালের ২০ ডিসেম্বর শরীফ ওসমান বিন হাদির জানাজা বাংলাদেশের এক ভিন্ন সময়কে সামনে আনে। জাতীয় নির্বাচনের প্রচারণাকালে ১২ ডিসেম্বর গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর সিঙ্গাপুরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তাঁর মৃত্যু হয়। দেশে ফেরার আগেই তিনি সাধারণ মানুষের আলোচনার কেন্দ্রে উঠে আসেন।
রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করা হয়, জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখা হয়। জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় তাঁর জানাজা অনুষ্ঠিত হয়—যা সাধারণ মানুষের জন্য খুব কমই উন্মুক্ত থাকে। সেখানে লাখো লাখো মানুষের উপস্থিতি জানাজাটিকে রূপ দেয় এক ঐতিহাসিক জনসমাবেশে।
শিক্ষার্থী, আন্দোলনকর্মী, শহীদ পরিবারের সদস্য, সাধারণ মানুষ ও রাজনৈতিক নেতারা সেখানে একত্র হন। দোয়ার পাশাপাশি শোনা যায় স্লোগান। শোকের ভেতরেই ক্ষোভ, প্রশ্ন ও অভিযোগ প্রকাশ পায়। অনেকের কণ্ঠে উঠে আসে—হাদিকে যেভাবে হত্যা করা হয়েছে, তার বিচার নিশ্চিত করা হোক এবং তাঁর মৃত্যুর প্রতিশোধ যেন নেওয়া হয়—এই দাবি (প্রতিবেদনভিত্তিক জনআবেগ)।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে হাদির দেশপ্রেমমূলক বক্তব্য ও ভিডিও ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে। তাঁর ভাষা ছিল সরল ও বাস্তব। বিভিন্ন বক্তব্যে তিনি নিজেই বলেছিলেন—তিনি স্বাভাবিক মৃত্যু চান না, শহীদি মৃত্যু কামনা করেন। গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করার মধ্য দিয়ে তাঁর সেই আকাঙ্ক্ষা মানুষের আবেগকে আরও গভীরভাবে নাড়া দেয়।
কাজী নজরুল ইসলামের কবরের পাশে তাঁর দাফন ছিল প্রতীকী—বিদ্রোহী কবির পাশে আরেক বিদ্রোহী কণ্ঠকে জায়গা দেওয়া। এটি কোনো কিছুর শেষ নয়; বরং চলমান প্রশ্ন ও দাবির ইঙ্গিত।
উপসংহার: জানাজা শুধু বিদায় নয়
এই তিনটি জানাজা দেখায়—জানাজা কেবল শেষ যাত্রা নয়। কখনো নীরবতায় ক্ষমতার ভয় প্রকাশ পায়, কখনো রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় কর্তৃত্বের বার্তা আসে, আবার কখনো লাখো লাখো মানুষের আবেগে ভবিষ্যতের রাজনীতি ও প্রতিরোধের দিকনির্দেশনা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। জানাজা তাই অনেক সময় রাষ্ট্র, ক্ষমতা ও জনমানসের ভাষা।